টেক্কা
– প্রলয় কুমার নাথ
“বৌ-বাচ্চাকে খাওয়ানো পরানোর যখন মুরোদ নেই, তখন বিয়ে করতে গিয়েছিলে কেন শুনি?”
আজকাল পরমার এই ধরণের মন্তব্য শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওঠে অনিন্দ্য। তার ভাবতেও অবাক লাগে, যে এ কি সেই পরমা! কলকাতার অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের একমাত্র মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও একদিন এই পরমাই আঁকড়ে ধরেছিলো নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে অনিন্দ্যর হাত! সেই কলেজের সময় থেকে দু’জনের প্রেম, অনিন্দ্য পিছপা হতে চাইলেও তাকে হার মানতে হয়েছে পরমার জেদের কাছে। একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে সাধারণ চাকরি জোটায় অনিন্দ্য, এই কথা জেনেও তার জন্য এক কাপড়ে নিজের পরিবারের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে পরমা। এই সব অনেক পুরোনো কথা, বর্তমানে শিয়ালদার একটি ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী এবং আট বছরের মেয়ে মলিকে নিয়ে ছোট্ট সংসার অনিন্দ্যর।
অনিন্দ্য পরমাকে বহুবার বোঝাতে চেষ্টা করেছে নিজেদের আর্থিক অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে, কিন্তু প্রতিবারই বিফল হয়েছে। নিজের বন্ধু-বান্ধব এবং চারপাশের আর পাঁচটা স্বচ্ছল পরিবারকে টেক্কা দেওয়ার জেদ চেপে গিয়েছে পরমার। একদিন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না অনিন্দ্য, সে পরমার চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে,
“আমি কিন্তু তোমাকে তুলে এনে বিয়ে করিনি, পরমা…তুমি নিজের ইচ্ছায় আমার জন্য বাড়ি ছেড়েছিলে। তোমার যদি মনে হয় আমার কাছে তুমি উপযুক্ত সুখ-স্বচ্ছন্দ পাচ্ছো না, তাহলে তোমার জন্য এই বাড়ির দরজা খোলা আছে…”
এই কথার কোনো জবাব দেয় না পরমা, শুধু তার সুন্দর চোখদু’টি ক্রোধের আগুনে জ্বলে ওঠে। সেই রাত্রে অনিন্দ্যর বিছানা ত্যাগ করে পরমা, এবং পরদিন সকাল থেকেই তার আর কোনো খোঁজ পায়না অনিন্দ্য।
এরপর কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি মাস। স্ত্রীকে হারিয়ে এবং মেয়েকে নিরন্তর মায়ের জন্য কৈফিয়ত দিতে দিতে হতাশ অনিন্দ্য একদিন জানতে পারে যে তাদের অফিসে নিযুক্ত হয়েছেন এক নতুন এইচ.আর ম্যানেজার। তিনি নাকি একে একে স্যাক করেছেন এমন কর্মচারীদের, যাদের গতবছরের পারফরম্যান্স খারাপ। এক সময় ডাক আসে অনিন্দ্যর! তাকেও বাধ্য করা হয় নিজে থেকে পদত্যাগ করতে। নিজের রেজিগনেশন লেটারটা এইচ.আর ম্যানেজারের হাতে দিতে গিয়ে বিস্ময়ে থরথর করে কেঁপে ওঠে অনিন্দ্য, কারণ সেই নব নিযুক্ত এইচ.আর ম্যানেজার আর কেউ নয়…তার স্ত্রী পরমা। তাচ্ছিল্যের সাথে বলে ওঠে পরমা, “তোমাকে বলেছিলাম না, একদিন আমি সকলকে টেক্কা দেবই!…যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যেই ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দেবো তোমার কাছে, আর আইন নিশ্চয় চাইবে না যে এমন চালচুলোহীন পিতার কাছে থেকে মলির ভবিষ্যৎ নষ্ট হোক…”
কেটে গিয়েছে আরো বেশ কয়েকটা বছর। পরমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সাথেই অনিন্দ্যকে হারাতে হয়েছে মলিকেও। আইন অনিন্দ্যর কর্মজীবনের বিফলতাকে ভর্ৎসনা করে, তার একমাত্র সন্তানের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে তার থেকে অধিক রোজগেরে পরমার হাতে। চাকরি এবং পরিবারকে হারিয়ে সর্বশান্ত অনিন্দ্য ভুগতে থাকে ডিপ্রেশনে। সে ঠিক করে শেষ করে দেবে নিজেকে। সেদিন রাত্রে একমুঠো ঘুমের ওষুধ মুখে পোরার ঠিক আগের মুহূর্তে বেজে ওঠে তার মোবাইল ফোন। থানা থেকে ফোন করা হয়েছে তাকে। অনিন্দ্য চমকে ওঠে, যখন সে শোনে যে গতকাল রাত্রেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে পরমা! সে ছুটে যায় থানায়, সেখানে পুলিশ তাকে বলে যে মৃত্যুর আগে পরমা কিছু কাগজপত্র দিয়ে যেতে চেয়েছিলো অনিন্দ্যকে। প্রথম কাগজটি হল একটি সম্পত্তির উইল, এবং দ্বিতীয়টি হল অনিন্দ্যর উদ্দেশ্যে পরমার লেখা একটি চিঠি, যাতে সে লিখেছে:
“অনিন্দ্য,
পারলে আমায় ক্ষমা করো। আমি বুঝতে পারিনি, যে সকলকে টেক্কা দেওয়ার জন্য সফলতার শিখরে উঠে যখন নিচের দিকে চাইবো, তখন কাউকেই দেখতে পাবো না। তার কারণ হল, এই আর্থিক স্বচ্ছলতা পাওয়ার জন্য সমাজের নানা মানুষের কাছে আমাকে ক্রমাগত বিকিয়ে দিতে হয়েছে শরীরের সাথে নিজের আত্মমর্যাদাকেও! যে মলিকে নিজের কাছে পেয়ে আমি মনে করেছিলাম যে এক বিরাট বড় যুদ্ধজয় করলাম, একদিন সেই আমাকে দেখে ফেললো এক পরপুরুষের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া অবস্থায়।
তার কান্না মাখা কচি গলার কথাগুলো যে এখনো আমার কানে বাজে, ‘তুমি খুব খারাপ, মামণি…এবার আমি বুঝতে পারলাম তুমি কেন বাপির সাথে থাকো না! আমি তোমার কাছে থাকবো না…কখনো না…আমি বাপির কাছে যাবো!’
সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমার সাথে প্রতিপত্তির যুদ্ধে জিতেও মনুষ্যত্বের যুদ্ধে হেরে গিয়েছি আমি। এমনই সময় আমার হাতে এসে পৌঁছলো বাবার বিপুল সম্পত্তির উইলটা, হয়তো শেষ সময়ে তিনি ক্ষমা করেছিলেন আমাকে। কিন্তু এত ধনসম্পত্তির মালিক হলেও, আমার সবচেয়ে প্রিয় বুকের ধন…আমার মলিই যে থাকতে চায় না আমার কাছে। তার এক জেদ, সে তোমার কাছে থাকবে! কিন্তু আমার যে তোমার কাছে ফিরে যাওয়ার আর কোনো মুখ নেই।
তাই বাধ্য হয়েই স্বেচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে মৃত্যুর আগে আমার সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি তোমার নামে লিখে দিলাম। সুখে থেকো অনিন্দ্য, মলিকে সুখে রেখো।
ইতি,
পরমা।”
***
আরো বেশ কয়েকটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। মলি এখন কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পরমার পৈতৃক সম্পত্তির মালিক অনিন্দ্য এখন প্রবেশ করেছে বার্ধক্যে। আর্থিক প্রাচুর্যে ভরা তার সংসার। এমনই একদিন এক সৌম্যদর্শন যুবকের হাত ধরে তার কাছে এগিয়ে এলো মলি। তারপর সে নতমুখে অস্ফুট স্বরে অনিন্দ্যকে বললো,
“আমি আর অসীম একে অপরকে খুব ভালোবাসি, বাবা…অসীম একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ চাকরিজীবী ছেলে হওয়া সত্বেও আমি ওকেই বিয়ে করতে চাই…আশা করি এতে তোমার কোনো অমত নেই!”
মুহূর্তের মধ্যে সচকিত হয়ে উঠলো অনিন্দ্য। মলির মধ্যে কত বছর আগেকার সেই কলেজ পড়ুয়া পরমাকে যেন দেখতে পাচ্ছে সে, আর অসীম নামক ওই যুবকের মধ্যে নিজেকে! টেক্কা দেওয়ার এই খেলার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায় আবার যেন কেঁপে উঠলো প্রৌঢ় অনিন্দ্যর বুক!
(সমাপ্ত)